ভাইভা পরীক্ষার কৌশল ও প্রস্তুতি
ভাইভা পরীক্ষার কৌশল ও প্রস্তুতি
ভাইবায় মূলত প্রার্থীর কি পরীক্ষা হয়ঃ
প্রথমে এই সত্যিটা বুঝতে হবে, ইতোমধ্যেই ২০০ মার্কের প্রিলি ও ৯০০ নাম্বারের রিটেনে নৈর্বক্তিক ও বিশ্লেষনমূলক জ্ঞানের যে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, ভাইবা সেই একই পরীক্ষা নয়। পদ্মা সেতুতে কত টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে কিংবা পেনাল কোডের ৩২০ ধারায় কি আছে কত শুধুমাত্র সেটা মুখস্ত জানি কিনা জানার জন্য এত অভিজ্ঞ সদস্যদের সমন্বয়ে মাসের পর মাসব্যাপী এত আয়োজন করে মুখোমুখি বসার এই ভাইবা বোর্ড গঠন করা হয়নি।
যারা প্রিলি ও রিটেন উত্তীর্ণ হয়ে ভাইবাতে এসেছেন তাদের সবার একটি যথেষ্ট পর্যায়ের জ্ঞান রয়েছে সকল বিষয়ে। এবার পালা আপনার ব্যক্তিমানুষকে উপস্থাপন করার। আপনি ভাইবার ১০-৪০ মিনিট কিভাবে আচরণ করেন, কোন প্রশ্নের জবাব কোন দৃষ্টিকোন থেকে দেন, কি ভঙ্গিতে দেন, আপনি যা জানেন তা আপনি তাৎক্ষনিক কাজে লাগাতে পারেন কিনা, আপনার আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা, আপনার নৈতিকতা, প্রত্যয়, বাস্তব জ্ঞান সবকিছুই চোখে পড়ে বিজ্ঞ সদস্যদের। কাউকে একেবারে সুপারডুপার হতে হবে না, শুধু মোটামুটি সব দিকেই একটা মিনিমাম কোয়ালিটি ধরে রাখুন। তাহলে আপনি যেকোন ভাইভা বোর্ডে ভালো কিছু আশা করতে পারেন।
ভাইবার তিনটি দিক নিয়ে কিছু আলোচনাঃ
১। জ্ঞান ও প্রস্তুতি
২। দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যক্তিত্ব
৩। ভাইবার শিষ্টাচার
১। জ্ঞান ও প্রস্তুতিঃ
জ্ঞান ও প্রস্তুতি তো সবচেয়ে মৌলিক বিষয়। প্রিপারেশন মেকস কনফিডেন্স। সার্বিক ও ভালো প্রস্তুতি ছাড়া আপনি কখনোই সম্পূর্ণ আত্মবিশ্বাস পাবেন না। কাজেই ভাইবায় যাবার আগে যথেষ্ট পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নিতে চেষ্টা করুন।
প্রস্তুতিরও অবশ্য লিমিট আছে। ভাইবার কোন সিলেবাস নেই। আপনি কতটুকু পড়লে বা প্রস্তুতি নিলে ভাববেন যে আপনার প্রস্তুতি মোটামুটি হয়েছে? এ ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিভঙ্গী হলো দুই দিক থেকে বিষয়টি চেক করে দেখতে পারেনঃ
সবাই যা জানে, আমি যেন তা জানি।
আমার আশেপাশের ভালো প্রার্থীরা যা জানে ন্যুনতম ততটুকু আগে নিশ্চিত করা। যে জিনিস এভারেজে সবাই জানে সেটা আমি না জানা অনেক বড় ঘাটতি। কথায় কথায় আমাকে জিজ্ঞেস করতেই পারে- “চীনে কমিউনিস্ট পার্টি কত সালে ক্ষমতায় আসে?”- এই প্রশ্নের উত্তর না জানাটা ততটা ডিসক্রেডিট না, এটা হয়তো অনেকেরই মনে থাকবেনা। কিন্তু আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করে “বাংলাদেশ কবে নিম্ন মধ্যম থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে?” এটা বলতে না পারা মানে সবাই জানে এমন একটা জিনিস আপনি জানেননা।
অবশ্যই মনে রাখবেন কয়টা প্রশ্নের উত্তর পারলেন বা পারলেননা সেটা গুনে মার্কস দেয়া হয়না। আপনাকে করা প্রশ্নের গুরুত্বের ওপর মার্কস নির্ভর করে।
বিষয়টা এভাবে নিতে পারেন- মুজিবনগর সরকারের সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের সচিব কে ছিলেন বলতে না পারলে হয়তো ২ নম্বর কাটা, কিন্তু মুজিবনগর সরকারের কোন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে কে ছিলেন বলতে না পারলে ১০ নম্বর কাটা।
তাই প্রথমেই কঠিন কঠিন বিষয় বাদ দিয়ে আগে সহজ ও সাধারন প্রশ্নগুলোর মার্কস শিওর করুন। তারপর আরো বিস্তৃত প্রস্তুতির দিকে যাবেন।
আমার যা জানা উচিত ছিল, আমি যেন তা জানি।
একজন বিসিএস প্রার্থী হিসেবে আমার যা জানা উচিত ছিল, তাই আমি জানি কিনা। এভাবেও কিছু প্রস্তুতি শিওর করতে পারেন। মনে করুন আমাকে স্থানীয় সরকার সম্পর্কে বলতে বললো। এখন এডমিন ফার্স্ট চয়েস দিয়ে যদি স্থানীয় সরকার কি সেটা ঠিকভাবে ভাবে উপস্থাপন করতে না পারি তাহলে বিসিএস প্রশাসন এ চাকরী করার প্রস্তুতি আমার হয়নি এটা মেনে নিতে হবে। তাই এই ধরণের প্রস্তুতির একটা লিস্ট করতে পারেন নিজের, একজন হবু সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে আমার ন্যুনতম কি কি প্রাকটিক্যাল ধারনা থাকা উচিত। আপনি নিজে ভাইবা বোর্ডে থাকলেও আপনি একজন ক্যান্ডিডেটের কাছে এসব প্রত্যাশা করতেন। বাংলাদেশ কিভাবে চলে, রাষ্ট্র কিভাবে চলে, সরকার কিভাবে চলে, দুনিয়ার কোথায় গুরুত্বপূর্ণ কি হচ্ছে, বাংলাদেশের সংবিধানের কোন গুরুত্বপূর্ণ ধারার তাৎপর্য কি এসব বিষয় যদি আপনার নিজের মোটামুটি পরিষ্কার ধারণা থাকে, আপনার বন্ধু জিজ্ঞেস করলে যদি আপনি তাকে সুন্দরভাবে বুঝিয়ে বলতে পারেন, তাহলে বুঝবেন আপনি ভাইভাতেও বলতে পারবেন, সেটা প্রেসিন্ডেন্সিয়াল ভাইভাই হোক আর যে ভাইবাই হোক না কেন।
মক ভাইবাঃ
আর প্রস্তুতির আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে যেটার ওপর আলোকপাত করতে চাই। অনেক সময় আমরা পর্যাপ্ত পড়াশোনা করে, ভাইবার সিলেবাস শেষ করে ভাবি মোটামুটি বেশ ভালো একটা প্রস্তুতি হয়েছে। কিন্তু আসলে প্রস্তুতি হয়েছে মাত্র অর্ধেক। বাকি অর্ধেকই হলো ভাইবার পরিস্থিতিতে নিজেকে বারবার ট্রেনিং দেয়া। এক্ষেত্রে একজন সংগী ঠিক করে নিন। তার সাথে প্রতিদিন অন্তত একটি ফরমাল ভাইবা দিন। গুছিয়ে কথা বলতে কেমন লাগে প্রতিদিন অভ্যাস করতে থাকুন। নিজেরা আনকমন ও খাপছাড়া প্রশ্ন তৈরী করে আলোচনা চালিয়ে যাবার অভ্যাস করুন। প্র্যাকটিসের সময় একই প্রশ্নে আপনার শুরুর দিনের উত্তর ও ১৫ তম দিনের উত্তর শুনলে নিজেই বুঝতে পারেন কতটা ম্যাচিওরড হয়ে গেছে আপনার রেসপন্স।
ভাইবার জন্য যা যা পড়তে পারেন ও মক ভাইবায় প্র্যাকটিস করতে পারেনঃ
১। সব বিসিএস এই সব প্রার্থীকেই কমবেশ কিছু রুটিন কোশ্চেন করে থাকে। যেমন নিজের পরিচয় দিন, বিসিএস কেন দিতে চান, পররাষ্ট্র প্রথম পছন্দ কেন, আপনার সাবজেক্টের জ্ঞান কিভাবে কাজে লাগাতে পারেন, বঙ্গবন্ধু কেন আমাদের জাতির পিতা, ৭ ই মার্চের ভাষনের তাৎপর্য কি ছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। গত বিসিএস গুলোতে বিভিন্ন গ্রুপে যারা ভাইভা অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছে সেগুলোতে চোখ বুলিয়ে এই প্রশ্নগুলোর একটা লিস্ট করবেন। হয়তো ৫০-৬০ টি কিংবা ১০০ প্রশ্নের একটা লিস্ট দাঁড়াবে আপনার। এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ঠোটের আগায় রাখতে হবে, ফ্লুয়েন্ট ও আত্মবিশ্বাসী হতে হবে এসব প্রশ্নের উত্তরে।
২। তারপর আরো কিছু ক্যাটাগরি করে সবগুলো ক্যাটাগরির প্রস্তুতি নেবেন। যেমনঃ
ক) নিজের সম্পর্কে- পরিচয়, নামের অর্থ, শখ, দৃষ্টিভংগী।
খ) বিশ্ববিদ্যালয়, হল, কলেজ, স্কুল সম্পর্কে।
গ) নিজের বিভাগ, জেলা, উপজেলা, এলাকার মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা, বিখ্যাত মানুষ, এমপি, মন্ত্রী, স্থান, নদী, উপকরন, খাবার, সংস্কৃতি, লোকগল্প, সাম্প্রতিক খবর, আর্থসামাজিক অবস্থা, নিজের এলাকার সমস্যা, সম্ভাবনা, করনীয় ইত্যাদি।
ঘ) সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ ও উন্নয়ন কার্যক্রম। শুধু বড় বড় প্রকল্প নয়, ছোট ছোট পদক্ষেপসহ। যেমন ভূমি ব্যবস্থা ডিজিটালাইজেশনে সরকার কি কি ব্যাবস্থা নিয়েছে ইত্যাদি।
ঙ) সাম্প্রতিক ইস্যুগুলো বিস্তারিত।
চ) বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে বিস্তারিত, রাষ্ট্রের গুরুত্বপুর্ণ ব্যক্তিবর্গের নাম যেমন, উপদেষ্টাগণ, জাতিসঙ্ঘে নিযুক্ত প্রতিনিধি, গভর্নর, মন্ত্রীপরিষদ সচিব ইত্যাদি ইত্যাদি।
ছ) মুক্তিযুদ্ধ ও সংবিধান।
জ) আপনার ক্যাডার চয়েসের প্রথমগুলো বিস্তারিত। বাকিগুলোর একেবারে ব্যাসিক ধারণাটা অন্তত রাখা।
৩।এরপর প্রস্তুতি নেবেন পরিস্থিতিভিত্তিক প্রশ্নের।
যেমনঃ বিদেশী ডেলিগেটদের সামনে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করে ৩ মিনিটের একটি বক্তব্য দিন। কিংবা বিদেশে একটি সম্মেলনে বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য একটি বক্তৃতা দিন। কিংবা আপনি একজন জেলা প্রশাসক- জেলায় বিজয় দিবসের অনুষ্ঠানে কিছু বলুন, কিংবা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত আছেন এমন কোন অনুষ্ঠানে তাদের এড্রেস করুন। আসলে অনেক ধরণের প্রশ্নই হতে পারে। আপনার যেটা করতে হবে, ৪-৫ টি প্রশ্নের চর্চা করে কমন ফরম্যাটটি বুঝে নিতে হবে। এরপর আপনাকে যে বিষয়েই বক্তব্য দিতে বলুক না কেন, আপনি গুছানো ফরম্যাটে কিছু না কিছু সুন্দর করে বলে আসবেন। ভালো মার্কস পাবার জন্য এটাই অনেক।
৪। পছন্দের কমপক্ষে ১ টি রুচিশীল কবিতা ও ১ টি গান চর্চা করে যাবেন। তারা চিত্ত বিনোদনের জন্য গান শুনতে চাইবেন না তাই খুব ভালো গাইতে হবে এমন না। কবিতা গানে অংশগ্রহণ করার সাধারণ সাবলীলতা আমার আছে কিনা দেখার জন্যই গান বা কবিতা আবৃত্তি করতে বলেন ভাইবা বোর্ড।
৫। আর ৫-৬ টি বই পড়ে ফেলবেন ভাইবা প্রস্তুতির। দেখবেন এক এক বইয়ের এক এক দিক ভালো। আর লাস্ট মুহূর্তে শুধু সবচেয়ে ভালো বইটা রিভিশন দিবেন বারবার। রেফারেন্স বইগুলো পড়ে ফেলবেন অবসর সময়ে। জাতির পিতার ৩ টি বই অবশ্যই পড়ে ফেলবেন ফ্রেশলি।
৬। অবশ্যই অবশ্যই প্রতিদিন পেপার পড়বেন।
মোটামুটি এই গেলো জ্ঞান ও প্রস্তুতির কথা।
২। দৃষ্টিভঙ্গী ও ব্যক্তিত্ব
ভাইবায় শুধু আমার প্রশ্নের উত্তরই আমাকে উপস্থাপন করেনা। দরজা খুলে ঢোকা থেকে বসে তাদের সাথে কথা বলা, আমার হাত নাড়ানো, আমার গলার স্বরের ওঠানামা, আমার দৃষ্টিভঙ্গী, আমার আত্মবিশ্বাস, আমার ভুল, কোন সমস্যা হলে ক্ষমাপ্রার্থনা, আমার কথোপকথন, সেটা শেষ করে সম্ভাষন জানিয়ে আসা ইত্যাদি- এই সব কিছু মিলিয়ে আমার ব্যক্তিত্ব চোখে পড়ে অন্যদের চোখে। আর ব্যক্তিত্বের উৎস হলো দৃষ্টিভঙ্গী। আমার মতে এই বিষয়টি ভাইবায় এবং জীবনের যে কোন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
এই অংশটুকু আলোচনার মূল কারণ- প্রস্তুতি যেমনই হোক না কেন, ভাইবা বোর্ড ফেস করা নিয়ে অনেকে টেনশন বা ভীতি বোধ করেন। ভাইবা বোর্ডে নার্ভাস বোধ করার কারণে জানা জিনিস ভুল করেন বা পরিষ্কার ভাবে বলতে পারেন না, স্মার্টলি উত্তর দিতে সমস্যা হয়, কিংবা আনকমন প্রশ্নে তাৎক্ষনিক কোন চিন্তা করতে পারেন না। তাই ভাইবার পড়াশোনার পাশাপাশি নিজের মনকে নেতৃত্ব দেওয়া ভাইবার সবচেয়ে বড় প্রস্তুতির একটি। আর সেজন্য, কিছু দৃষ্টিভংগীর বিষয়ে আপনার নিজেকে প্রতিদিন মোটিভেট করতে হবে।
এক এক জনের দৃষ্টিভংগী এক এক রকম। আমার কাছে যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে আমি উল্লেখ করছি।
ক) ভাইবা শুধু আমারই পরীক্ষা নয়, বোর্ড সদস্যদের জন্যও পরীক্ষা- তাই টেনশন অর্ধেক তাদেরকেও দিন।
আমি ভাইবা দিতে যাচ্ছি আমার যোগ্যতা প্রমাণের জন্য। আর বোর্ডের সদস্যদের জন্যও এটা পরীক্ষা যে তারা যোগ্য প্রার্থীকে যাচাই করতে পেরেছেন কিনা। যদি উনি সরকারী গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য সঠিক মানুষটি বাছাই করতে না পারেন, সরকারের কাছে ও নৈতিকভাবে তিনি দায়বদ্ধ থাকেন। যেহেতু উনিও উনার যোগ্যতার পরীক্ষা দিচ্ছেন, আপনিও আপনার যোগ্যতার পরীক্ষা দিচ্ছেন, তাহলে টেনশন আপনি একা করবেন কেন? আপনার অর্ধেক টেনশন মনে মনে উনাদের ওপর দিয়ে দিন।
খ) মুক্ত ও সত্য মনে প্রবেশ করুন– নির্ভার লাগবে।
বিমান বাহিনীর ফাইনাল প্রেসিডেনসিয়াল ভাইবা কক্ষের সামনে বসে যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন সেই দরজার গায়ে প্রার্থীদের জন্য বড় করে লেখা ছিল- Enter with open mind! যিনি নিজের বিষয়ে নির্ভার থাকতে চান, তার জন্য এই কথাটি অনেক দামী। নির্ভার থাকতে পারার কারণ হলো মার্ক টোয়েনের উক্তির মত- If you tell the truth, you don’t have to remember anything। আপনি কেন এই ভাইবা রুমে প্রবেশ করছেন, কেন বিসিএস দিচ্ছেন, কেন পররাষ্ট্র, প্রশাসন বা পুলিশ আপনার প্রথম পছন্দ, সত্য বলতে কেন আপনি আপনার সাবজেক্ট ছেড়ে এই ফিল্ডে আসতে চান এসব প্রশ্নের উত্তর সার্বিকভাবে মুক্তমনে তৈরী করুন। তাহলে আপনি অনেক নির্ভার থাকবেন ও আপনার উত্তর মুখস্ত গৎবাধা উত্তরের মত শোনাবেনা। আইবিএ তে কেন পড়তে চাই এই প্রশ্নের উত্তরে আমিও বলেছিলাম যে উদ্যোক্তা হতে চাই তাই। উত্তর শুনে বোর্ডের ম্যাডাম হেসে বলে ফেললেন- আইবিএ তে এসে সবাই দেখি শুধু উদ্যোক্তা হতে চায়। শুধু মুখস্ত উত্তর খুবই মেকি শোনায়। উনারা একই উত্তর হাজারবার শোনেন। তাই উত্তরে আন্তরিকতার পার্থক্যটা সহজেই ধরা পড়ে উনাদের কাছে।
তবে একটা উদাহরণ দিয়ে বলি- এখানে অনেকের একটা কথা থাকে যে সবসময় মুক্তমনে উত্তর দিলে চলেনা। মনে হতে পারে যে, সত্যি বলতে তো বিসিএস এর চাকরী টা ভালো তাই আমি এই পরীক্ষা দিতে এসেছি, দেশের সেবা করতে এসেছি এটা তো আসল কারণ না। এখন এটা তো সরাসরি খারাপ শোনায়। কিন্তু সত্যি কথা হলো কেউ নিজের প্রয়োজনে দেশের উৎপাদনে অবদান রাখলেই সেটা দেশকে অবদান রাখা। তাছাড়া আমি মনে করেছি আমার দক্ষতা কাজে লাগিয়ে আমি এখানে ভালো কিছু করতে পারব, সেজন্যই আমি বিসিএস দিয়েছি। যদি ভাবতাম আমার সেই সক্ষমতা নেই, তাহলে কিন্তু পরীক্ষা দিতাম না। তাই আসলে সবগুলো বিষয়ই কমবেশি কোন না কোনভাবে সত্যি। আমরা সেটা বুঝতে পারিনা। তাই কেন বিসিএস প্রশাসন আপনার প্রথম পছন্দ তার প্রচলিত সবগুলো কারণই আপনি বলতে পারেন- Just feel them, and then tell them with an open feelings.
৩। একজন সম্মানিত মানুষ হিসেবে আপনার ব্যক্তিত্বের নেতৃত্ব আপনার হাতে রাখুন।
আপনি পিএসসির বোর্ড মেম্বার, পিএসসির চেয়ারম্যান, মহামান্য রাষ্ট্রপতি, ভ্লাদিমির পুতিন কিংবা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট যার সামনেই ভাইবা দেন না কেন আপনি একজন সম্মানিত মানুষ। আমি যতই অদক্ষ, অযোগ্য হই না কেন, প্রিপারেশন খারাপ হোক, পারফরম্যান্স খারাপ হোক না কেন, এইটুকু সম্মানের আমি প্রাপ্য। তাই নিজের সম্মান ও নিজের নেতৃত্ব অনুভব করুন। ভাইবা বোর্ডের সামনে বসা নিয়ে কোন টেনশন বা ভয় অনুভব করবেন না। পৃথিবীতে আল্লাহর জাস্ট আরেকজন বান্দাকে ভয় পাওয়া মানে নিজেকে অসম্মান করা। কারোর সামনে নিজেকে ছোট মনে করবেননা। আপনার বয়সে পিএসসির মেম্বারদের জ্ঞান ও আপনার কাছাকাছিই ছিল। আবার উনাদের বয়সে গিয়ে আপনি একজন অভিজ্ঞ ও জ্ঞানী মানুষ হবেন। তাই নিজেদের সম্মান বজায় রেখে নিউট্রাল ফিলিংস নিয়ে ভাইবা দিয়ে চলে আসবেন। ব্যক্তি হিসেবে আত্মবিশ্বাসী, দায়িত্বশীল, সক্রিয় বোধ করুন, তা আপনার প্রশ্নের উত্তরে, চলাফেরায় প্রতিফলিত হবে। মানুষ হিসেবে আপনার সক্ষমতা কতটুকু, আপনার সম্পর্কে এই ধারণাই বদলে যাবে মানুষের।
আর উত্তরেও ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন ঘটান। অনেকে উত্তর দেন, বাবা মায়ের খুব ইচ্ছা আমি বিসিএস প্রশাসন এ চাকরী করি, তাই আমি বিসিএস এ আসতে চাই। এটা খুব ভালো কারণ, কিন্তু অনেক প্যাসিভ কারণ। ব্যাপারটা এমন বাবা মার শখে পরীক্ষা দিতে আসা, এখানে তিনি আর গুরুত্বপুর্ণ চরিত্র নন। অপরদিকে যার নিজের মাল্টি ডাইমেনশনাল একটা আলোচনা থাকব, তিনি অবশ্যই নিজের পদক্ষেপের বিষয়ে বেশ সচেতন সেটা বোঝা যাবে।
৪। ভাইবা বোর্ডে যাই হয়ে যাক, ভড়কাবেন না। ঢুকবেন যে মুডে, বের হবেন সেই মুডে।
ভাইবা বোর্ডে আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর ভুল হতে পারে। অপরিচিতি প্রশ্ন আসতে পারে। তাতে একেবারেই ভড়কাবেন না। আপনি ভড়কে গেলে পরের উত্তর গুলো খারাপ বৈ ভালো হবেনা। আর ভাইবার মাঝখানে বসে এটা ভেবে বসবেন না আপনার ভাইবা খারাপ হচ্ছে। অনেক খারাপ ভাইবা দিয়ে, অনেক প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে অনেকে বিসিএস প্রশাসন পেয়েছেন। এটা আসলে বোঝা যায়না সবসময়, আবার আপনার রিটেনের মার্কসের সাথে মিলিয়ে আপনার কোন একটা ক্যাডার চলে আসতে পারে। তাই আপনাকে যেসব প্রশ্ন করা হচ্ছে, সেসবের একটারও উত্তর না পারলেও পরিমিত হাসিতে বলুন- দুঃখিত, আপনি এটার উত্তর জানেননা।
আর আমার ক্ষেত্রে যদি জানা না থাকে বলি যে- জানা নেই। পড়েছি কিন্তু মনে নেই এমন হলে বলি- “দুঃখিত, এই মুহূর্তে মনে করতে পারছিনা” । যদি স্পেসিফিক কোন সংখ্যা মনে না পড়ে, বলি যে- “স্পেসিফিক সংখ্যাটা মনে নেই” । যদি কোন বিষয় শুনিনি কিন্তু হালকা দুই এক লাইন বলতে পারব, তাহলে বলি- “না শুনে থাকলেও অল্প ধারণা আছে” ।
একটা রেজুলিউশন রাখুন- যদি পুরো ভাইবার একটা প্রশ্নও না পারেন, তাহলেও আপনি মুখ শুকনা করা বা মন খারাপ করে রাখলে কোন মার্কস বাড়বে না। তাই প্রশ্ন যাই পারেন বা না পারেন, যে এক্সপ্রেশন নিয়ে আপনি ভাইবা শুরু করেছেন, সেই আত্মবিশ্বাসের এক্সপ্রেশন নিয়েই ভাইবা শেষ করবেন। আপনাকে দেখে যেন মনে না হয় আপনি নিজেই আশাভঙ্গ হয়েছেন, যেন দেখে মনে না হয় আপনি বিব্রত হচ্ছেন। প্রশ্ন না পারা সত্ত্বেও সহজ, স্বাভাবিক ও প্রত্যয়ী থাকলে আপনাকে নিয়ে উনারা আরো একটু চেষ্টা করে দেখতে পারেন। হতে পারে আপনাকে একটা সহজ প্রশ্ন করে ফেললো, আপনি সেটা পেরে গেলেন, কথা নতুন করে আবার এগোলো।
৩। ভাইবার শিষ্টাচারঃ
ভাইবার কোন নিয়ম নেই, আছে শিষ্টাচার। স্যুট, টাই পড়তে হয় কিনা, দাড়ি নিয়ে যাওয়া যায় কিনা এগুলোর কোন নিয়ম নেই এবং কোন নিয়ম মানতে আমরা বাধ্য নই। শুধু আমাদের রুচি আমাদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানান দেয় অন্যদের কাছে। তাই ভাইবার শিষ্টাচারগুলো নিশ্চিত করতে হয় যেন তা আমাদের ব্যক্তিমানুষকে সঠিক ও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলে।
পোশাক ও সাজঃ
আমাদের দেশে অফিস আদালতে ছেলেদের জন্য শার্ট প্যান্ট ফর্মাল পোশাক হিসেবে পরিচিত। পাঞ্জাবী-পায়জামা ও পড়তে পারেন। পাঞ্জাবী পড়লে সাদা পাঞ্জাবীই ফরমাল হিসেবে বেশি গ্রহণযোগ্য। শার্টের রঙ সাদা বা হালকা নীলের কোন শেড হলে সেফ। স্যুট যে পড়তেই হবে এমন কোন কথা নেই। তবে নিজেকে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করার জন্য স্যুট পড়তে পারেন। স্যুট নেভি ব্লু, কালো কিংবা এশ রঙ এর বাইরে না যাওয়াই সেফ। টাই স্যুটের রঙ এর সাথে মানানসই রঙ এর নিন। যাদের গরমে কষ্ট হয়, তাদের খুব গরমে ভাইবা হলে স্যুট না পরলেই ভালো। স্যুট না পড়লে ২ মার্কস কম দিবেনা কোনভাবে। আমি গরমের মধ্যেও স্যুট পড়েছিলাম কারণ স্যুট পড়ে নিজের কাছে ভালো লাগছিল। আপনার নিজের মানসিক আরামটাই এখানে মুখ্য এটা মনে রাখবেন। যাই পড়েন সেটাকে পরিপাটি করে পড়াটাই জরুরি। শুধু শার্ট হলে সুন্দর ইস্ত্রী করা পরিষ্কার একটা শার্টই যথেষ্ট।
মেয়েরা সালোয়ার কামিজ বা শাড়ি যেটাতে কমফোর্টেবল সেটা পড়তে পারেন। শুধু যারা শাড়ি পড়তে একদমই অভ্যস্ত নন, শাড়ি পড়লে শাড়ি সামলাতে আপনাকে অনেক সচেতন ও ব্যাস্ত থাকতে হয়, তারা সালোয়ার কামিজ পড়লেই সবচে ভালো করবেন। তাহলে ভাইবায় আপনার পুর্ণ মনযোগ দিতে পারবেন।
দাড়ি শেভ ই করে ফেলতে হবে এমন কোন কথা নেই। যারা ধর্মীয়ভাবে দাড়ি রাখেন তারা তো নিঃসন্দেহে রাখতে পারেন। কোন সমস্যা নেই। আর যারা হালকা চাপদাড়ি রাখেন, সেটাকে গুছিয়ে মার্জিত শেপ করে রাখবেন। খুব বোল্ড এবং চোখে পড়ে এমন যে কোন ডিজাইন পরিহার করবেন। চুল কাটার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।
এখানে মূল উদ্দেশ্য দুটি- মার্জিত উপস্থাপন ও আপনার কমফোর্ট। যিনি কখনো শেভ করেননা, তিনি হঠাৎ শেভ করলে নিজের লুকের ব্যাপারে ইনসিকিওর ফিল করতে পারেন। তার জন্য সুন্দরভাবে দাড়ি রাখাই ভালো কারন চাপ দাড়ি কোন অমার্জিত বৈশিষ্ট্য নয়। যিনি মনে করবেন শেভ করলে উনার নিজেকে ভালো লাগবে, উনি শেভ করে ফেলবেন।
কক্ষে প্রবেশঃ
একজন স্বাভাবিক মানুষ যেভাবে স্বাভাবিক প্রয়োজনে কোন ঘরে প্রবেশ করে, সেই মানসিকতা নিয়েই প্রবেশ করুন। জড়সড় হয়ে মুখ চিমসে করে ভাইবা কক্ষে ঢোকা আপনার জন্য সম্মানজনক নয়। বেল বাজানোর পর দরজা পরিমিত পরিমানে খুলে কক্ষে ঢোকার অনুমতি নিন। Let your face to be a comfortable and happy face. Any other tensed and uncomfortable expression won’t help you in any ways and would make others less happy too. অনুমতি পেলে স্বাভাবিকভাবে কক্ষে প্রবেশ করুন।
বোর্ডের সামনে দাড়িয়ে তাদের সম্ভাষন জানান। ধরুন সালামের মাধ্যমে সম্ভাষন জানাচ্ছেন, তাহলে সালামের সময় এবং পরপরই তিনজনের সাথেই হৃদ্যতাপূর্ণ দৃষ্টিবিনিময় করুন।
বসাঃ
যদি স্যাররা বসতে বলেন, ধন্যবাদ জানিয়ে বসুন। যদি বসতে না বলেন, তাহলে বসার অনুমতি চান। অনুমতি দিলে ধন্যবাদ বলুন। যদি স্যুট পড়া অবস্থায় থাকেন তাহলে রুলে ঢোকার সময় স্যুটের বোতাম লাগানো থাকবে, কিন্তু বসার আগে বাম হাতে ওপরের বোতামটা খুলে বসবেন। দরকার হলে জেমস বন্ডের ভিডিও দেখতে পারেন, বসার আগে কি স্টাইল করে স্যুটের একটা বোতাম খুলে বসে! হা হা।
কথা বলার সময়ঃ
কথা বলার সময় স্বাভাবিক ভংগীতে কথা বলুন। উনারা একটূ দূরে বসেন যেহেতু, তাই স্পষ্ট আওয়াজে কথা বলুন। জড়তা রাখবেন না। ভাইবা শুধু কুইজের মত কোন প্রশ্নোত্তর পর্ব নয়। আলোচনার মত করে কথা বলবেন। আলোচনার মাধ্যমে বেটার কমিউনিকেশন ঘটে।
তিনজন সদস্যের দিকেই তাকিয়ে কথা বলতে হবে এবং সবার সাথেই কমিউনিকেট করতে হবে। তবে যা এটেনশন তা তিনজনের মধ্যে সমানভাবে ভাগ করে দেয়ার জন্য আবার বার বার ঘাড় ঘুরানোর দরকার নেই। সেটা অস্বাভাবিক দেখাবে। আপনাকে যদি কেউ ছোট কোন স্পেসিফিক প্রশ্ন করে তাহলে সেটা প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়েই উত্তর দিতে পারেন। কিন্তু আপনাকে যদি বিবৃতিমূলক কোন প্রশ্ন করে, তাহলে একটু রিলাক্সে সবার দিকে তাকিয়েই কথা বলবেন। আবারো বলছি সমানভাবে সবার দিকে তাকাতে হবে এমন না। জাস্ট মাঝে মাঝে স্বাভাবিকভাবে তাকাবেন আরকি।
ভাইবা শেষেঃ
আপনার ভাইবার শেষ পর্যায়ে এসে ভাইবা বোর্ড হয়তো বলবেন, আপনি এবার আসতে পারেন। আপনার ভাইবা যত ভালই হোক, আর যত খারাপই হোক না কেন, খুবই সন্তষ্টচিত্তে তাদের ধন্যবাদ ও সালাম দিয়ে হাসিমুখে বের হয়ে আসবেন। আপনি বের হলে উনারা মার্কিং করবেন। আপনার লাস্ট ইম্প্রেশন দেখে হয়তো মনে হতেও পারে আপনার ভাইবা মনে হয় অত খারাপ হয়নি।
কিছু সামারি:
১। ৫-৬ টা ভাইবা গাইড পড়ে ফেলুন। রেফারেন্স বই পড়ুন।
২। ৫০-৬০ টা রেগুলার প্রশ্নের উত্তর নিজের মনে মনে অথবা নোট করে তৈরী রাখুন।
৩। সবগুলো ক্যাটাগরির প্রশ্ন নোট করে পড়ুন।
৪। প্রতিদিন কারোর সাথে মক ভাইবা দিন।
৫। প্রতিদিন পেপার পড়ুন।
৬। মানসিকভাবে একজন প্রত্যয়ী, ধীরস্থির, বুদ্ধিমান মানুষ হিসেবে নিজেকে ট্রিট করুন।
সব কথার শেষ কথাঃ
শেষমেষ, যতটুকু প্রিপারেশন নিতে পারবেন ততটুকুই আলহামদুলিল্লাহ। যা কিছু আছে তাই নিয়েই ভাইবা বোর্ডে চলে যেতে হবে। পারফেকশনিস্ট হবার কোন প্রয়োজন নেই। এইটুকু দিয়েই বেস্ট ভাইবা হয়ে যেত পারে।
আর একবার খারাপ হলে আরো ভালো প্রস্তুতি নিয়ে পরেরবার আরো ভালো করে দিন ইনশাল্লাহ।
আর সব কথার শেষ কথা, ভাইবা যেমনই দেন আপনি, রেজাল্ট আপনার হাতে নয়। কাজ আপনার হাতে, ফল স্রষ্টার হাতে। তাই নিজের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব করবেন, বাকিটা স্রষ্টার হাতে ছেড়ে দিয়ে বলবেন- আমার জন্য যেটা ভালো সেটাই আমাকে দাও। সব ইমোশন এক জায়গায় ইনভেস্ট করে না ফেলাই ভালো।
যদি কারোর সামান্যও উপকারে লাগে, সেটুকুই লেখার পরিশ্রমটুকু সার্থক হবার জন্য যথেষ্ট। ধন্যবাদ!!!
-নাহিয়ান মুনসীফ
.jpeg)
Comments
Post a Comment